রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি
মুসলিম উম্মাহর জীবনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রতিবছর পবিত্র রমজান আগমন করে। রহমত ও সহানুভূতির এই মাস শুরু হতে হাতে গোনা আর মাত্র অল্প কয়েকদিন বাকি।
রমজান হলো আত্মশুদ্ধি, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মগঠনের মাস। এই মাসে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং মানুষকে কষ্ট না দেওয়া অনেক বড় নেক আমল।
পবিত্র রমজানকে বলা হয় দুঃখীজনের ব্যথা-বেদনা অনুভবের মাস। গরিব, অসহায় ও অনাহারীদের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করার মাস। এই মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, পারলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে ছাড় দেওয়াই ব্যবসায়ী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হওয়া উচিত। আর ইসলামের শিক্ষাটাই হলো- রমজানে যেকোনোভাবে মানুষের উপকার করা; অপকার করা নয়। তাই তো বেশি বেশি দান-সদকা করা ও রোজদারকে খাওয়ানো রমজানের বিশেষ ২টি ইবাদত।
বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে রোজাদারের সওয়াব সামান্যও কমানো হবে না। (তিরমিজি: ৮০৭)
আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো রমজান এলে মহানবী (সা.) কী করতেন? আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রমজান মাস শুরু হতো, তিনি অসহায়দের সেবায় কোমর বেঁধে নেমে যেতেন। ঘরে-পরিবারের লোকদের দ্বীন সচেতন করতেন। রাতভর জেগে ইবাদত করতেন। (বুখারি: ২৪১৭৭) অন্য বর্ণনামতে, আল্লাহর রাসূল (সা.) রমজানে কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়ে অধিক দানশীল হয়ে যেতেন’। (বুখারি: ০৬; মুসলিম: ২৩০৮; মুসনাদে আহমদ: ২৬১৬)
দেখুন হাদিসের শিক্ষা কত মহান আর বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর! হাদিসের সারমর্ম হলো, ‘রমজানে মানুষ মানুষের উপকারে আসবে; কোনোভাবেই রোজাদারকে কষ্ট দেবে না’। যদিও কষ্ট দেওয়া যেকোনো সময় নিষেধ, কিন্তু রমজানে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টগুলো থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, কেয়ামতের কষ্টগুলো থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে, আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ছাড় দেবেন…’। (মুসলিম: ৭০২৮)
এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন’। (তিরমিজি: ১৮৪৭)
দুঃখজনক হলেও সত্য- একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রমজান মাসকেই টাকার পাহাড় গড়ার সুযোগ হিসেবে বেছে নেয়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার ফন্দি আঁটে। বিশেষ করে ইফতার ও সেহরিতে ব্যবহৃত খাদ্য সামগ্রির দাম বাড়ানোর একটি প্রতিযোগিতা প্রতিবছরের স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছাড়াও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনও কষ্টকর হয়ে পড়ে। অথচ নবী করিম (সা.) এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’। (তিরমিজি: ১২১০)
যারা পণ্য মজুদের মাধ্য সংকট সৃষ্টি করে তারা শুধু পরকালে নয়, ইহকালেও আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি হবে বলে হাদিসের সতর্কতা রয়েছে। একদিকে তাদের উপার্জন হারাম হওয়ায় নামাজ, রোজা, হজসহ কোনো নেক আমলই কবুল হবে না। উপরন্তু তাদের সঙ্গে আল্লাহ তাআলা সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আল্লাহ দূরে গেলেন তার কাছ থেকে’। (মুসনাদে আহমদ: ৮/৪৮১)
মালামাল মজুদ করে চড়াদামে বিক্রয়কারীদের ওপর নবী (স.)-ও অভিসম্পাত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ন্যায্যমূল্যে জিনিস সরবরাহকারী রিজিকপ্রাপ্ত আর মজুদ করে সংকট সৃষ্টিকারী অভিশপ্ত’। (বুখারি: ৩৭১২) আরেক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৩৮)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে আগুনের পাহাড়ে উঠিয়ে শাস্তি দেবেন। (তাবারানি: ২১০)
আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করে থাকে। রমজানে এটাই হওয়া উচিত। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। এটি খুবই হতাশাজনক। এ অবস্থায় সরকার, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্রব্যমূল্যরোধে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। আসুন, সবাই মিলে পবিত্র রমজান মাসকে গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করি। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্য, সংহতি ও সহানুভূতিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই। মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনই হোক আমাদের মূল লক্ষ্য। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।