নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬
জাতীয় : রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬-এ দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৪১ জনের মরদেহ গতকাল স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় বাকি পাঁচ মরদেহ হস্তান্তর হবে ডিএনএ পরীক্ষার পর।
ভবনটির বেশির ভাগ দোকান ও রেস্তোরাঁয় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল নানা ধরনের কৃত্রিম সরঞ্জাম। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সরঞ্জামের কারণে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া পুড়ে যাওয়া কৃত্রিম সরঞ্জাম থেকে নানান ধরনের বিষাক্ত ধোঁয়া নিঃসৃত হয়, যা অগ্নিকাণ্ডকে আরো প্রাণঘাতী করে তোলে।
আটতলা গ্রিন কোজি কটেজের অবস্থান বেইলি রোডের নাটক সরণিতে। ভবনের নিচতলায় স্যামসাংয়ের প্রদর্শনী কক্ষসহ (শোরুম) আটটি দোকান রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় আছে ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্তোরাঁর শাখা। তৃতীয় তলায় তৈরি পোশাকের দোকান। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় আছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ। অষ্টম তলায় মসজিদ ও ভবনের কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরো ভবনের এতগুলো শোরুম, দোকান ও রেস্টুরেন্টে ওঠানামার জন্য একটিমাত্র সরু সিঁড়ি ছিল। ভবনের পশ্চিম ও পূর্ব পাশে রয়েছে বহুতল ভবন।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রিন কোজি কটেজের চারপাশে পড়ে আছে ভাঙা কাচ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন দোকান-রেস্তোরাঁর পুড়ে যাওয়া চেয়ার-টেবিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরে ভবনের ভেতরে উদ্ধার অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধারকারী দলের সদস্য (ফায়ারফাইটার) মো. রাসেল আবেদীন জানান, ভবনের পাঁচটি ফ্লোরে রেস্তোরাঁ ছিল। এসব রেস্তোরাঁ সাজাতে নানা ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা রঙের কাগজ, কাঠের মেঝে, পিভিসি ফ্লোর ম্যাট ও ফোম।
এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র শাজাহান সিকদার বলেন, ‘রাজধানীর অধিকাংশ বিপণিবিতান ও রেস্তোরাঁ সাজানোর জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। এসব সরঞ্জাম আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াতে থাকে। এ ধোঁয়ায় শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডকে অতিমাত্রায় প্রাণঘাতী করে তোলে।’
গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘যারা মারা গেছেন, তাদের বেশির ভাগই কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ কেউ যখন একটা বদ্ধ ঘর থেকে বের হতে পারেন না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালিতে চলে যায়।’ মন্ত্রী জানান, যারা চিকিৎসাধীন, তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন।
অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নাজুক থাকায় গ্রিন কোজি কটেজের মালিক পক্ষকে গত অক্টোবর সতর্ক করে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় ভবনটি পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক অধীর চন্দ্র হাওলাদার। পরিদর্শন প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ভবনটি পরিদর্শন করে দেখা যায়, অগ্নি ও জননিরাপত্তার দিক থেকে খুবই নাজুক অবস্থায় আছে, যা আদৌ কাম্য নয়।’ ওই প্রতিবেদনে ‘ফায়ার সেফটি প্ল্যান’ প্রস্তুত করতে ভবন মালিককে ৯০ দিনের সময় দেয়া হয়।
গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল দাবি করে ভবনের ব্যবস্থাপক জামিমুল আলম বলেন, ‘ভবনের অগ্নিনিরাপত্তায় কোনো ত্রুটি ছিল না। নিচতলার দোকানগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম সরঞ্জাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত।’
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ স্পেশালিস্ট আশরাফুল আলম বলেন, ‘দুটি মরদেহের চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আমরা স্বজনদের ডিএনএ নমুনা রেখেছি। নমুনা পরীক্ষা শেষে তাদের প্রকৃত পরিচয় জানা যাবে। এছাড়া মর্গে থাকা আরো তিনটি মরদেহের জন্য এখনো কোনো স্বজন আসেননি। আগুনের ঘটনায় নিহত ৪১ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশ্রাফুল ইসলাম আসিফ, ঢাকার বংশালের মো. নুরুল ইসলাম, মালিবাগের পপি রায়, যাত্রাবাড়ীর সম্পূর্ণা পোদ্দার, আরামবাগের নাজিয়া আক্তার, নাজিয়া আক্তারের ছেলে আরহান মোস্তফা আহমেদ, মতিঝিলের মাইশা কবির, তার বোন মেহেরা কবির দোলা, হাতিরঝিলের সৈয়দা ফাতেমা তুজ জোহরা, সৈয়দ আব্দুল্লাহ, সৈয়দ মোবারক, স্বপ্না আক্তার, হবিগঞ্জের মাধবপুরের রুবি রায়, একই পরিবারের বিয়াংকা রায়, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার তুষার হাওলাদার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার জুয়েল গাজী, নোয়াখালীর শ্যামবাগের আসিফ, চাঁদপুরের কে এম মিনহাজ উদ্দিন, মুন্সিগঞ্জের জারীন তাসনিম প্রিয়তী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. শান্ত হোসেন, ভোলার দিদারুল হক, নয়ন, পাবনার ফরিদপুরের মো. সাগর হোসেন, কুমিল্লার ফৌজিয়া আফরিন রিয়া, ব্রাহ্মণপাড়ার জান্নাতিন তাজরীন, মুরাদনগরের সম্পা সাহা, মাদারীপুরের কালকিনির মো. জিহাদ হোসেন, কুমিল্লার নুসরাত জাহান শিমু, মৌলভীবাজারের আতাউর রহমান শামীম, যশোরের মো. কামরুল হাবীব হাসান রকি, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মেহেদি হাসান।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ‘কাচ্চি ভাই’-এর ব্যবস্থাপক জয়নুদ্দিন জিসানসহ তিনজনকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। অন্য দুজন হলেন গ্রিন কোজি কটেজের ‘চুমুক’ কফি শপের দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘আগুনের ঘটনায় অবহেলার কারণে মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করবে। ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ মামলা করতে চাইলে মামলা করতে পারবেন।’