ধর্ম

রোজার শিক্ষার সাংঘর্ষিক কাজ এড়িয়ে চলার লাভ

সব অনৈতিকতাকে দূরে ঠেলে আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাস রমজান। জীবনের সব ধরনের অনিয়মকে বিতাড়িত করে নিয়মতান্ত্রিকতার অনুশীলনের মাস এটা। তাই এ মাসে মুমিন-মুসলমানরা বেশি বেশি সৎ কাজে মনোনিবেশ করেন, গর্হিত কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হওয়ার প্রয়াসে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন।

রোজা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম বিধায় আল্লাহ তার সব বান্দার জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকে রোজাকে ফরজ করেছেন। রোজার উদ্দেশ্য হলো- তাকওয়া অর্জন করা। যেমনটি মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা দিলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো।’ -সুরা আল-বাকারা : ১৮৩

‘তাকওয়া’ মানে ভয় করা, বেঁচে থাকা, বিরত থাকা, আত্মরক্ষা, আত্মশুদ্ধি বা মুক্তি ইত্যাদি অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত থাকা বা আত্মরক্ষার নামই হলো- তাকওয়া। রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো- সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়াভিত্তিক জীবনাচারণে অভ্যস্ত হওয়া, আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করা এবং তার সব নেয়ামতের পূর্ণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মহান রবের কাছে সমর্পণ করা। সুবহে সাদেক বা ভোরের সূক্ষ্ম আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার, পাপাচার, কামাচার ও যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা এবং প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করা, সেহরি খাওয়া, রাত্রে তারাবির নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকাসহ নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তির যে অনন্য অনুশীলন রমজান মাসে শুরু হয় তা সারা বছর লালন করতে পারলে একজন সাধারণ মানুষও অসাধারণ মর্যাদায় পৌঁছে যেতে পারেন।

কারণ সঠিকভাবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে যে রোজা পালন করে এবং যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকে সে শিশুর মতো নিষ্পাপ হওয়ার সুযোগ লাভ করে। রোজা ধৈর্য, সংযম, আত্মত্যাগ ও মানবিক সহানুভূতির শিক্ষা দেয়। মানুষ নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামি থেকে মুক্ত করার দীক্ষা গ্রহণ করে। রোজা শুধু ইসলাম ধর্মেই নয় বরং হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মেও উপবাস ব্রত রয়েছে। রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও। রমজান আমাদের সাম্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, উদারতা, দানশীলতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সত্যনিষ্ঠা, ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দেয়।

সারা দিন উপবাস থাকার ফলে শরীর ও আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহজ হয় এবং পাশবিকতার চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্তি দেয়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, অন্তর বিগলিত হয় মহান প্রভুর কৃতজ্ঞতায়। মাহে রমজান হলো- মানবিক কল্যাণবোধে উজ্জীবিত হওয়ার এক রাজপথ। রোজাদার সারা দিন উপবাস থাকে বিধায় অভাবী, অন্নহীন এবং দরিদ্র মানুষের কষ্ট বুঝতে পারে, ফলে গরিবদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। জাকাত ও সদকাতুল ফিতর পরিশোধের মাধ্যমে যেমন দ্বীনি দায়িত্ব পালন করা হয়, তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতা লাঘবে জাকাত বিশাল ভূমিকা রাখে। জাকাতের ন্যায্য বণ্টন সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে এনে ভারসাম্যপূর্ণ আর্থিক সংগতি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

এক কথায়, রোজা সব ভালো কাজের একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ এবং গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার সুবর্ণ সুযোগ-সংবলিত মহিমান্বিত মাস। তাই মুসলিম বিশ্বে যুগে যুগে আত্মশুদ্ধির অনন্য সোপান হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে মাহে রমজান।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় অনৈতিক নানা প্রতিযোগিতা। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে একশ্রেণির মুনাফালোভী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি করে অধিক লাভের পাঁয়তারা করে, ফলে দরিদ্র মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়, যা অত্যন্ত গর্হিত ও অমানবিক কাজ। রমজানের শিক্ষার সঙ্গে এসব কাজ ও মানসিকতা সরাসরি সাংঘর্ষিক।

রমজানে যেখানে ব্যবসায়ীদের উদার হওয়ার কথা, পণ্যমূল্য কমিয়ে রাখার কথা, সেখানে অনেকেই বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, যা শুধু ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনৈতিক নয়, প্রচলিত আইনেও অপরাধ। অসাধু ব্যবসায়ী আর এসব কালোবাজারির ব্যাপারে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে আগুনের পাহাড়ে উঠিয়ে শাস্তি দেবেন।’ -তাবরানি : ২১০

শুধু ব্যবসায়ী নয় মানুষও ব্যক্তিগতভাবে রমজানে অনেক অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যায়, যা থেকে বেঁচে থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। আমাদের সব সময় স্মরণ রাখা দরকার, জীবনের সব বৈধ কাজ ইবাদতের শামিল। হোক সেটি ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকরি বা অন্য যেকোনো পেশা। আর রমজানে যেকোনো সৎ কাজের পুরস্কার অন্য এগারো মাসের চেয়ে বহু গুণ বেশি মিলে, এমতাবস্থায় আমরা যদি বিশুদ্ধ নিয়ত ও বৈধপন্থায় কাজগুলো করি, তাহলে সেটাও ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে।

তাই সবাইকে পেশাগত জীবনে শুদ্ধতা আনার অনুশীলন করতে হবে রমজান মাসে। সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে রমজানে আত্মসংযমে ব্রতী হয়ে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা নিলে সমাজ থেকে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জবরদখল, হানাহানিসহ সব পাপাচার ও গর্হিত কাজ থেকে নিজেরা যেমন পরিত্রাণ পাব, তদ্রুপ ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য পূর্ণ সমাজ গঠনের পথ ত্বরান্বিত হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button