সহসা কাটছে না গ্যাস সংকট, বিদ্যুতেও লোডশেডিংয়ের শঙ্কা
গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় আবাসিক থেকে শিল্প সর্বত্র ক্ষোভ বাড়ছে। ইফতারের সময় গ্যাস না থাকায় অনেক এলাকায় চুলা জ্বলছে না বলে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা।
ভোক্তাদের পাশাপাশি গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ বিভাগের অবস্থাও নাকাল। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ কমিয়ে দিলে লোডশেডিং অবধারিত, শিল্প ও আবাসিক খাতে এমনিতেই ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ উভয় সংকটের মুখে পড়েছে।
আর কোন বিকল্প না পেয়ে সিএনজি ফিলিং স্টেশন ৬ ঘণ্টা বন্ধকেই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। প্রথম রোজায় সিএনজি ফিলিং স্টেশন বিকেল ৫ থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত বন্ধের আদেশ জারি করা হয়। চব্বিশ ঘণ্টা না গড়াতেই সিদ্ধান্ত বদলে বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধের আদেশ জারি করা হয়।
কিন্তু তাতেও খুব একটা পরিস্থিতি উন্নতি হবে বলে মনে করছে না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে সিএনজি খাতে গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। সেটুকু বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া যাবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পেট্রোবাংলার (১৩ থেকে ১৪ মার্চ) দৈনিক গ্যাস সরবরাহ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২৬৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর গ্যাস ফিল্ড থেকে ৮১৮ মিলিয়ন ঘনফুট, দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর ফিল্ড থেকে ১২৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানি করে সরবরাহ করা হয়েছে ৬২৩ মিলিয়ন ঘনফুট। আর চাহিদার নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান ঘোষণা না করা হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার মিলিয়ন বলে বলা হয়।
গ্যাস সরবরাহ নিয়ে গত ১৩ মার্চ বিদ্যুৎ ভবন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, পেট্রোংবাংলা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। অনুষ্ঠান শেষে তিনি বলেন, আমরা ২০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করতাম। একটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) নিয়মিত সার্ভিসিংয়ে থাকায় গ্যাস সরবরাহ ১০ শতাংশ কমে গেছে। সার্ভিসিংয়ে থাকা এফএসআরইউ ৩০মার্চের আগে আসবে না। এতে কিছুটা সংকট রয়ে গেছে।
আবাসিকে গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আবাসিকে গ্যাস সংকট হলে এলপিজি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু বিকল্প রয়েছে, তাই আবাসিক নিয়ে আপাতত চিন্তা করছি না। আমরা চাচ্ছি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে। তবে মার্চে বিদ্যুতে কিছুটা বিভ্রাট হতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে ১৩ মার্চ গ্যাস অভাবে ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল। আরও ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আংশিক উৎপাদন করেছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী ওই দিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে মাত্র ৯০৮ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চাহিদার অর্ধেকের মতো।
সেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার (২৮ ডিসেম্বর ২০২৩) বিপিডিবি দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ন্যূনতম ১৫৪০ মিলিয়ন সরবরাহের কথা জানায়। ওই সভায় বিপিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, গতবছর সেচ মৌসুমে এপ্রিল মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। ২০২৪ সালের সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের সামগ্রিক চাহিদা ১৭ হাজার ৮০০মেগাওয়াট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেচ খাতে মার্চে ১৯৪৯ মেগাওয়াট, এপ্রিল ও মে মাসে ২৫৯০ মেগাওয়াট হতে পারে।
গ্রীষ্ম মৌসুম এখনও সেভাবে তোপ দাগাতে শুরু করেনি। এখনই বিদ্যুৎ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছে না। এপ্রিল নাগাদ সেচের চাহিদা আরও ৬’শ মেগাওয়াটের মতো বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে ফ্যান ও এসির লোড যুক্ত হবে।
একটি সুখবর হচ্ছে সার্ভিসিংয়ে থাকা সামিটের এফএসআরইউ এপ্রিল নাগাদ অপরেশনে চলে আসবে। তখন সরকার চাইলে দৈনিক আরও ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে পারবে। তবে সেখানে অনেক যদি এবং কিন্তু রয়েছে। একদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম।
রাজধানী ঢাকাসহ অনেক এলাকাতেই গ্যাস সংকট বিরাজ করছে। বিশেষ করে বিকেল বেলা যখন ইফতারের জন্য রান্না করা হবে তখন লাইনে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে অনেকেই তাদের ক্ষোভ ঝাড়ছেন সোস্যাল মিডিয়ায়।
অন্যদিকে শিল্পেও বেহাল অবস্থা। গত ৬ মার্চ পেট্রোবাংলার গণশুনানিতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস চাইলেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে ঈদে কর্মীদের বেতন-বোনাস প্রদান নিয়ে শঙ্কার কথা জানান। গাজী গ্রুপের জিএম আলমগীর আকন্দ বলেন, গ্যাসের সরবরাহ না বাড়ালে খুবই সংকটে পড়বো, উৎপাদন করতে না পারলে আগামী ঈদে বেতন-বোনাস দিতে পারব না।
আকবর কটন মিলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) বলেন, ভালুকা জোনে দেড় মাস ধরে গ্যাসের অভাবে দিনের বেলা বসে থাকতে হয় রাতে কারখানায় কাজ চলে। এখন শ্রমিকদের ছুটিও দিতে পারছি না। এভাবে চললে ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়া কঠিন হবে।