মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি বঙ্গবন্ধু ও ভবা পাগলা
বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি জাতীয় চরিত্র অর্জন করেছিলেন যে তাকে নিয়ে লোকমুখে ছড়া যেমন রচিত হয়েছে, তেমনি রচিত হয়েছে গান।
সাধারণ মানুষের সম্মিলিত রচনা নয় কিংবা অজ্ঞাত মানুষের রচনা ও সুরারোপ নয় বলে একে পণ্ডিতেরা হয়তো লোকগান বলতে চাইবেন না। কিন্তু চিরায়ত লোকগানের সুর ও ভাব রয়েছে যেখানে। তাই সরাসরি লোকগান বলতে না চাইলেও লোকধারার গান বরতে আমাদেও নিশ্চয়ই আপত্তি থাকার কথা নয়। এসকল গান রচনা করেছেন সমকালের মানুষ, তার অনুরক্ত মানুষ। গানগুলোর বেশির ভাগই পরিবেশিত আমার পল্লিগীতির সুরে। ভাটিয়ালি, বাউল কিংবা বিচ্ছেদি গানের সুর এসেছে মিলেছে বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত এ সকল গানে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচয়িতা বা পদকর্তা হিসেবে আসে ভবা পাগলা-র (১৯০০-১৯৮৪) নাম। ঢাকা জেলার ধামরাই থানার আমতা গ্রামের এই সাধকশিল্পী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি গান রচনা করেছেন। এই গানে নদীমাতৃক বাংলাদেশে বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশের সুসন্তানদের প্রতিবাদী ভূমিকায় জেগে উঠার আহ্বান এবং তাদের কান্ডারি হিসেবে শেখ মুজিবর রহমানের অধিষ্ঠান কামনা করা হয়েছে। গানটির আস্থায়ীতে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের বন্দনা করা হয়েছে-
(আজি) পদ্মার জল লাল
যমুনার জল কালো
ব্রহ্মপুত্র অতীব ভীষণ, মেঘনা নদী অতি বিশাল
এই যে আস্থায়ীতে যমুনার জল কালো বলার মধ্য দিয়ে কানু ছাড়া গীত নাই সেই চিরায়ত প্রবাদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। যমুনা এলেই আমাদের মনে পড়ে কদম্বতল, রাধা আর কালো কানাই বা শ্রীকৃষ্ণের কথা। আর এখানে পদ্মার জল লাল বলতে পঁচিশে মার্চে রাতে ঢাকায় খানসেনাদের গুলিতে ঢাকার মানুষের রক্তের কথা বলা হয়েছে।
প্রথম অন্তরায় বলা হয়েছে শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, হুরাসাগর ও ভৈরবনদের প্রসঙ্গ। শতধারারূপা ঢাকেশ্বরী মাতাকে ঢাল-তরোয়াল হাতে বিরাজ করার কথা বলা হয়েছে।
শীতলক্ষ্যা, শান্তময়ী, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী
হুরাসাগর, বৈরবনদ, শতধারারূপা ঢাকেশ্বরী
কুমারটুলী বিরাজিছে মাতা, হাতে নিয়ে ঢাল-তরোয়াল
দ্বিতীয় অন্তরায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গোপন নিষ্ঠুর মাতাল খানসেনাদের হামলার প্রতিবাদ রয়েছে, আবার মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছেন অসুরকে ধ্বংস করতে-
মহাদেবী প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ঢাকা শহরে
মহিষাসুর-মর্দিনী মা গো, ধ্বংস করো অসুরে
দেবতার স্থানে, একি গোপনে
এলো কারা ওরা নিষ্ঠুর মাতাল।
সাধক পদকর্তা ভবা পাগল বলেছেন যে এদের ঠান্ডা করার জন্য ন্যায়ের ডান্ডা হাতে শত শত সন্তান প্রস্তুত রয়েছে। এবং এই সন্তানদের জননী কে?
বাংলার জননী, ফাতেমা।
দেবতার স্থান হিসেবে পূজিত মন্দির রক্ষায় বাংলার জননী ফাতেমা জলে ঘিরে রক্ষা করছে। কী অসাম্প্রদায়িক বোধের বিকাশ ফুটে উঠেছে এই গানের বাণীতে-
এবে হবে সকলই ঠান্ডা
সন্তান রয়েছে শত শত সেথা,
হাতে লয়ে ন্যায় ডান্ডা
খণ্ড খণ্ড রূপে বাংলার জননী,
ফাতেমা ঘিরিছে জাল।
একবার ঢাকেশ্বরী দেবী বা মহিষাসুর-মর্দিনী মা অর্থাৎ দুর্গাকে আহ্বান জানাচ্ছেন আবার মা ফাতেমার সন্তানেরা ন্যায়ের ডান্ডা নিয়ে এগিয়ে আসছেন বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কী অপূর্ব সমন্বয়চিন্তা ফুটে উঠেছে ভবা পাগলার গানে, ভাবলে বিস্ময় জাগে।
চতুর্থ অন্তরায় তিস্তা ছিন্নমস্তায় ত্রিধারায় শিশুহত্যার রক্তপ্রবাহের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এ-রকম অনাচারীদের বধ করার জন্য কারো আগমন প্রত্যাশা করেছেন। অপরাধী শিশুপালকে বধ করার জন্য যেমন শ্রীকান্ত ভূমিকা রাখেন। আজ দেশের অবস্থা এমন হয়েছে কৃষ্ণ ও শিশুপাল কাউকেই রেহাই দিচ্ছে না। উভয়কে বধ করার জন্য যে পাকিস্তানি হানাদাররা তৎপর। কবির ভাষায়—
তিস্তা ছিন্নমস্তা,
ত্রিধারা বহিছে রক্তধারা
কে রে করে শিশুহত্যা
মাভৈঃ রবে গর্জিছে আকাশ, বধিতে কৃষ্ণ-শিশুপাল।
তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী। পৌরাণিক বিশ্বাস মতে, এটি দেবী পার্বতীর স্তন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাই এর জল পবিত্র। তিস্তা শব্দটি এসেছে ত্রি-স্রোতা বা তিন প্রবাহ থেকে। বাংলাপিডিয়া মতে, সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এ নদীটি সৃষ্টি হয়েছে। এটি দার্জিলিং-এ অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ে তিস্তা একটি বন্য নদী এবং এর উপত্যকা ঘনবনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য এলাকায় এর নিষ্কাশন এলাকার পরিমাণ মাত্র ১২,৫০০ বর্গকিলোমিটার। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৭৮৭ সালের ব্যাপক বন্যায় নদীটির গতিপথ বদল করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়। এই তিস্তাকে তিনি ছিন্নমস্তা বলেছেন। ছিন্ন মস্তা মানে যার মস্তক ছিন্ন করা হয়েছে। পুরাণে এক দেবীর কথা বলা হয়েছে যিনি প্রচণ্ড শক্তিময়ী। তাকে মহাশক্তি বা প্রচণ্ডচণ্ডিকা বলা হয়। তিনি একহাতে নিজের মস্তক কেঠে আরেক হাতে ধরে রাখেন। তখন খণ্ডিত স্থান থেকে ত্রিধারায় রক্তের স্রোতে প্রবাহিত হয়। সেই রক্ত পান করেন ছিন্ন মস্তক আর দুই সহচরী। এই যে ত্রিস্রোতধারা, তার সঙ্গে তিস্তার তুলনা করেছেন সাধক কবি। একাত্তরে এরকম তিনধারায় রক্তস্রোতে প্রবাহিত হয়েছে বলে গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝানো হয়েছে।
তাই ভবাপাগলার অভিমানী আহ্বান ধ্বনিত হয় শেষ অন্তরায়-
ভবাপাগলার অভিমান
আর কেন দেরি, শোনো হে কান্ডারি
মুজিবরে হও অধিষ্ঠান
সুসন্তান তোমার নিয়েছে এ ভার
(আজি) ধরিতে বাংলার হাল।
এই নিদারুণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কান্ডারি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বেছে নিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক ও সংগীত পদকর্তা। কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনে নয় মন্দিরবাসী সাধুর কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মতৎপরতা এ গানটি তারই প্রমাণ। এখানে কান্ডারিকে বা সৃষ্টিকর্তাকে আহ্বান জানানো হয়েছে শেখ মুজিবুরের উপর অধিষ্ঠিত হতে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকেই কান্ডারি করার প্রার্থনা জানিয়েছেন। আর সাধারণ বাঙালি সুসন্তান সোনার বাংলাকে স্বাধীন করার দায়িত্ব নিয়েছে, অর্থাৎ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই বার্তাটিও তিনি স্রষ্টার কাছে পৌঁছে দেন। গানটি রচিত হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনায় বসে। ১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অতির্কত হামলায় যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়, তার প্রতিবাদে এই গানটি রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রচিত এই গানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়।