মুক্তকথা

শহীদ জোহা আমার আদর্শিক শিক্ষক

আমি জোহা স্যারকে সরাসরি পাইনি। আমি ক্যাম্পাসে যাবার ১৪ বছর আগেই স্যার গত হয়েছেন। তবে রাবি প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাঁর সমাধির দিকে প্রতিদিন যতবার তাকিয়েছি, ততবার তাঁর চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার তাঁর ছাত্র ও দেশের জন্য জীবন দিতে পারেন, তাহলে আমি কেনো পারবো না। আর তাই বুঝি রাবিতে ভর্তির পর থেকে জোহা স্যারের চেতনায় শাণিত হয়ে জীবন বাজি রেখে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। তাই আমি বলি, চোখের দেখা না দেখেও শহীদ জোহা স্যার আমার আদর্শিক শিক্ষক, আমার সাহস আর প্রেরণার উৎস।

যে স্যার বলতে পারেন- ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর আইয়ুব খান সরকার হামলা চালালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সন্ধ্যায় সবার সামনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এসব কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।

১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুর খবর শুনে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা তখন বুঝতে পারেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি নিজের জীবনবাজি রেখে ছাত্রদের মূল ফটক থেকে ফিরে যেতে বলেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন মিছিলের সম্মুখভাবে অবস্থান করছিল। এই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে ছাত্রদের প্রাণ বাঁচাতে শামসুজ্জোহা স্যার নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন সেনাদের। বলেছিলেন, ‘দয়া করে গুলি ছুঁড়বেন না, আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে এখান থেকে।’ কিন্তু সেনারা তার সব কথা উপেক্ষা করে গুলি চালাতে গেলে ড. জোহা নিজে এগিয়ে যান। তখন তার ওপরই গুলি চালায় সেনারা। আহত ড. জোহাকে সেনাবাহিনীর ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় মিউনিসিপ্যাল অফিসে। সেখানে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে দীর্ঘসময় অবহেলায় ফেলে রাখা হয়। পরে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪টার দিকে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই এই মহান শিক্ষক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরে মহান এই শিক্ষককে সমাহিত করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে। যা এখন জোহা চত্বর বা জোহার মাজার নামে পরিচিত। এছাড়া শহীদ ড. জোহাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি হলের নামকরণ করা হয় শহীদ শামসুজ্জোহা হল। ২০০৮ সালে শহীদ ড. জোহা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।

ড. সৈয়দ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনে একটি স্কলারশিপ পান। ১৯৬৪ সালে তিনি লন্ডন থেকে ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মহান এই শিক্ষকের প্রতি সন্মান জানিয়ে ১৮ই ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে ঘোষনার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে দেশের শিক্ষক ও ছাত্র সমাজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button