প্রবাস জীবন

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের কাজ নেই বেতন নেই, আছে নির্যাতন

পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনতে লাখ লাখ টাকা ধারকর্জ করে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন হাজারো তরুণ। কিন্তু সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল রুঢ় বাস্তবতা। তাদের জন্য সেখানে নেই কোনো কাজ, ফলে নেই বেতন। কোনো রকম দুই বেলা পেটে-ভাতে খেয়ে কাটছে তাদের দিন। কাজ নিয়ে তোড়জোড় করলেই সেসব প্রবাসীদের কপালে জুটছে নির্যাতন।

সৌদি আরবের পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। ১২ লাখের বেশি কর্মী রয়েছে সেখানে। কিন্তু নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া স্থগিত করেছিল মালয়েশিয়া। তবে, ২০২২ সালে ১৫টি দেশের জন্য শ্রমবাজার আবারো খুলে দেয় দেশটি। সেটা ছিল আনন্দের খবর। এরপর থেকে চার লাখের বেশি বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় গেছেন। শুধু ২০২৩ সালেই গিয়েছেন ৩ লাখ ৫১ হাজারের বেশি প্রবাসী। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদার চেয়ে বেশি শ্রমিক যাওয়ায় অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ পাচ্ছে না।

ভাগ্যান্বেষণে আসা এমনই একজন আশাবাদী অভিবাসী শ্রমিক নেত্রকোণার জহিরুল ইসলাম। গত বছরের জানুয়ারিতে বিদেশি কর্মীদের জন্য শিথিল নিয়োগ নীতির সুবিধা নিয়ে সাত মাস আগে মালয়েশিয়া আসেন তিনি। এজন্য তার খরচ করতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। বিশেষ স্কিমের অধীনে, নিয়োগকর্তাদের ‘নিয়োগের পূর্বশর্ত এবং যোগ্যতা কোটা’ ছাড়াই তাদের বর্তমান চাহিদা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

একমাত্র শর্ত ছিল বিদেশি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেড় হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বা ৩২০ ডলার) দিতে হবে।

৩০ বছর বয়সী জহিরুল কুয়ালালামপুরের বিকস এসডিএন বিএইচডিতে একটি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ পেয়েছিলেন, যেখানে তাকে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৫০০ রিঙ্গিত দেওয়া হবে যা ওভারটাইম এবং অন্যান্য ভাতার সাথে দ্বিগুণ হতে পারে।

তিনি বলেন, সেখানে কাজ নাই, বেতনও নাই। আমাদের দিনে দুবার খাবার দেয়- ভাত আর ডাল। গত ২ মার্চ কুয়ালালামপুরের একটি হোটেল থেকে ফোনে জহিরুল এসব কথা বলেন। তিনি জানান, সেখানে তিনি এবং আরো প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি আছেন।

প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০ বাংলাদেশিকে নিয়োগ দিলেও তাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। কয়েক সপ্তাহের জন্য, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে অল্প কিছু রিঙ্গিত কিংবা অনেককে বিনা বেতনে অন্য একটি কোম্পানিতে কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আরো কষ্টের বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি কর্মীদের পাসপোর্ট নিয়ে নিচ্ছে। ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা দিলে তারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান পরিচয়পত্র ফেরত পেতে পারেন।

কেউ হোটেল থেকে বের হলে তাকে আর ফিরতে দেওয়া হয় না এবং এভাবে তারা অবৈধ হয়ে যান। অর্থাৎ বিদেশি শ্রমিকদের হোটেলে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।

জহিরুলের সঙ্গে থাকা শাকিল খান নামে একজন সাহস করে কাজের সন্ধানে হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় কোনো কাজ তিনি পাননি। মাগুরার ২৯ বছর বয়সী এই যুবক বাংলাদেশে থেকে ধার করে পাঠানো তার পরিবারের টাকায় এখানে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে এখানে আসতে আমি যে ঋণ নিয়েছিলাম কথা ছিল এখানে কাজ করে সেই ঋণ শোধ করার। এখন আমি নিজে বেঁচে থাকার জন্যই আরো ঋণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। এর চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে?

মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর কয়েক মাস পর তার বাবার মৃত্যু তার উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মা, স্ত্রী আর দুই বছরের ছেলে তাদের নিজের বেঁচে থাকার জন্য যেমন অর্থের যোগানের কথা ভাবতে হচ্ছে, আবার আমার জন্য এখানে টাকা পাঠানোর জন্য তাদের চিন্তা করতে হচ্ছে।

শাকিলসহ ছয়জন মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগে অভিযোগ দায়ের করে রায়ের অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, ‘আগামী দুই মাসের মধ্যে ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে না পারলে আমি নথিভুক্ত হবো না।’

অভিবাসী অধিকার কর্মী ও গবেষক অ্যান্ডি হলের হিসাব অনুযায়ী, শাকিল ও জহিরুলের মতো এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি এখন মালয়েশিয়ায় কর্মহীন, অবৈতনিক, কম বেতন ও ঋণগ্রস্ত।

এতে প্রশ্ন উঠেছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার জন্য দায়ী কে।

বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, দুই দেশের সিন্ডিকেট অতিরিক্ত কোটা অনুমোদন করায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন অভিবাসন বিশ্লেষকেরা।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় এক হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক মামলাও করেছেন। কিন্তু তারপরও দেশে ফিরতে পারছেন না তারা। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসও তাদের কোনো সহায়তা করছে না।

এদিকে, অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় এক হাজার বাংলাদেশি নিয়োগকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে তার অভিযোগ আছে আমাদের কাছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, সেখানে যাওয়ার পর তাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি।

শাকিরুল ইসলাম আরো বলেন, দেখা যাচ্ছে কোথাও হয়তো ৫ জনের কাজ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও কোনো কোনো কোম্পানি ৫০ জনের অনুমোদন দিয়ে ৫০ জনকে তারা সে দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর তারা আর কাজ দিতে পারছে না।

কাজের তুলনায় বেশি কোটা অনুমোদন দেওয়ায় অনেক শ্রমিককে ভুগতে হচ্ছে। এছাড়া মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানালেও ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। সিন্ডিকেট ব্যবসার কারণেই এই সমস্যাটা হচ্ছে।

এদিকে হাইকমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে, অতিরিক্ত কোটা অনুমোদনের প্রবণতাটি সম্প্রতি বেড়েছে। কিছু সিন্ডিকেট আছে, যারা কোটার ব্যবসা করে।

প্রবাসীদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে তারা নিজেদের আর্থিক ও বৈষয়িক ব্যাপারকেই বড় করে দেখছে। আবার মালয়েশিয়া ঘোষণা দিয়েছে এ মাসের পর নতুন করে কোনো চাহিদাপত্র ইস্যু করা হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button