আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বছর ঘুরে আবার এসেছে অমর একুশ। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর পার হলেই বাংলাদেশের সকল প্রান্তে শোনা যাবে গাফফার চৌধুরীর লেখা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরের অমর সৃষ্টি সেই কালজয়ী গান – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো…’
আমাদের পাশের বাংলাভাষী অঞ্চলসমূহেও এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত বসবাসরত বাঙ্গালিরাও পিছিয়ে থাকবেন না। কাল একুশের সারাদিন ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে পালিত হবে গৌরবের দিনটি। হবে প্রভাতফেরি, শহীদ মিনার সমূহে শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দিবসের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা সভা, বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন আমাদের সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, সফিউরেরা। তাঁদের সাথে জেগে উঠেছিল সারা পূর্ব বাংলা। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় আসীন করেই জনতা ঘরে ফিরেছেন।
সেই বিজয়ের অনুপ্রেরণায় তাঁরা বার বার পাকিস্তানি লাণ্ছণা, বণ্চণা ও নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সেই পথ ধরেই ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি জেনোসাইড শুরুর পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পাকিস্তানি শাসনমুক্ত করে আমাদের মাত্ভূমিকে। বাংলা ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালীদের পূণ্য ভূমি হিসাবে অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক, সমাজ সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
একুশের সাথে সাথে উনিশের কথা উল্লেখ করতেই হয়। আসামের বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীরা দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৬১ সালের ১৯ মে কাছাড়ের শিলচরে একাদশ তরুণ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাকে তাঁদের বরাক ভূমির জন্য আসামের একটি সরকারি ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ভাষার জন্য প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সেই এগারজনের পুরোভাগেই ছিলেন।
একুশে উনিশের সাথে সাথে মানভূমের বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলনের কথাও চলে আসে।বহু প্রাণ বলিদান ও বহু বছরের সংগ্রামের পর তাঁদের আন্দোলনের সাফল্য আসে। মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী বৃহৎ অংশ নিয়ে পুরুলিয়া জেলা বিহার থেকে এসে পশ্চিম বঙ্গের অংশ হয় ১৯৫৬-তে। তাই বলে ভাষার জন্য সংগ্রাম কেবল বাঙ্গালীরাই করেছে এমন নয়। একটি জাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে হলে তার সংস্কৃতি এবং ভাষাকে ধ্বংস করার টার্গেট করা হয় আদিকাল থেকেই। দক্ষিণ আমেরিকার উন্নত সভ্যতার মায়া,আজটেক, ইনকা জাতিসত্তাকে স্পেনিয় উপনিবেশবাদীরা ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি শেষ করে দেয়ার মাধ্যমে।
আজকের দিনেও একই জুলুম চলছে কুর্দি, ইয়াজিদি, রোহিঙ্গা, উইঘুর ও অন্যান্য বহু জনগোষ্ঠীর ওপর। আমাদের একুশে নতুন মাত্রা পেয়েছে ২০০০ সাল থেকে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর প্যারিস সন্মেলন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ ২০০০ সাল থেকেই এই দিনটি পালন করে আসছে।
দিবসটির অঙ্গীকার হলো পৃথিবীর বুক থেকে আর কোনও ভাষাকে হারিয়ে যেতে দেয়া হবে না। প্রতিটি মানুষের নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার জন্মগত অধিকার রয়েছে। পৃথিবীর সকল দেশ ও দেশসমূহের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পৃথিবীতে এখন মোটামুটিভাবে ৭০০০ ভাষা জীবিত রয়েছে। অর্থাৎ ব্যবহার হয়ে থাকে। ১৫০০’র মত ভাষা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে। এই সংখ্যা আর বাড়তে না দেয়ার অঙ্গীকার জাতিসংঘের। এখানে উল্লেখ করার মত গর্বের বিষয় রয়েছে আমাদের।
কানাডার ভ্যাংকুভারে বসবাসরত কিছু বাংলাদশি তাঁদের অন্য দেশের বন্ধু বান্ধব দের নিয়ে মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটি গঠন করে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে জাতিসংঘের কাছে এই দাবি তোলেন ১৯৯৮ সালে। বহু দেন-দরবার হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারও এতে সংশ্লিষ্ট হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সাদেকের ও ভ্যাংকুভারের রফিক ও আবদুস সলামের অক্লান্ত পরিশ্রম ১৯৯৯-তে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এই সাফল্যের জন্য মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে এবং আবদুস সলাম ও রফিক বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বেসামরিক সন্মাননা একুশে ও স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। আমাদের একুশে আজ এভাবেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। চলুন আমরাও অঙ্গীকার করি জগতের সকল ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
জয় আমাদের বাংলা ভাষার জয়! জয় জগতের সকল মাতৃভাষার জয়।