আন্তর্জাতিক

দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে গাজা-সুদান, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার

টানা পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় আকাশ ও স্থলপথে হামলা করে চলেছে ইসরায়েল। এতে করে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ওই ভূখণ্ডটিতে তীব্র মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।

খাবারের অভাবে গাজার ফিলিস্তিনিরা ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের (ইউএন) একটি সংস্থা। সেই সঙ্গে সুদানে চলমান সংঘাত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্ষুধা সংকটের কারণ হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে (ইউএন)।

দুর্ভিক্ষ কী এবং কখন তা ঘোষণা করা হয়?

খাবারের তীব্র সংকটের ফলে একটি দেশের জনগোষ্ঠী গুরুতর অপুষ্টি, অনাহার বা মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়লে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাধারণত কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে কিনা, সেটা ঘোষণা করে জাতিসংঘ।

কখনো কখনো দেশটির সরকারের সাথে এবং প্রায়শই অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বা মানবিক সংস্থাগুলোর সাথে মিলে এই ঘোষণা দেয় সংস্থাটি। সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তা পর্যায় বা আইপিসি নামের জাতিসংঘের একটি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তীব্রতার পাঁচটি ‘পর্যায়ের’ ভিত্তিতে একটি দেশের খাদ্য ঘাটতি বা খাবারের নিরাপত্তাহীনতার র‍্যাঙ্কিং করা হয়, যার পঞ্চম ও সর্বশেষ ধাপ দুর্ভিক্ষ।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় তিনটি জিনিস ঘটতে হবে:

১. কমপক্ষে ২০ শতাংশ পরিবার খাদ্যের চরম সংকটের মুখোমুখি হবে
২. কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগবে
৩. দশ হাজার মানুষের মধ্যে প্রতিদিন দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক বা চারটি শিশু ‘সম্পূর্ণ অনাহার বা অপুষ্টিতে ভুগে কিংবা এবং রোগে আক্রান্ত হয়ে’ মারা যাবে

গাজা ও সুদান কেন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে?

জাতিসংঘের মতে, উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন আর ২০২৪ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে যেকোনো সময় তা ঘটতে পারে। ইসরায়েলের ওপর হামাসের সাত অক্টোবরের হামলার পর গাজায় কয়েক মাস ধরে চলা সংঘর্ষের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

আইপিসির শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী, গাজার প্রায় ১১ লাখ মানুষ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ক্ষুধার্ত। পরিস্থিতি যদি সবচেয়ে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় তাহলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে গাজার সবাই দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে।

জাতিসংঘ বলেছে, আইপিসির নথিভুক্ত যেকোনো অঞ্চল বা দেশের তুলনায় গাজায় বেশি সংখ্যক মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

অন্যদিকে, সুদানে চলমান সংঘাত দেশটিকে ‘সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মানবিক দুর্দশায় নিমজ্জিত করছে’ বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা, যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম ক্ষুধা সংকটের কারণ হতে পারে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে সুদানের প্রায় এক কোটি আট লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়েছে।

আর কোন কোন দেশ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে?
অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার একটি নামের মানবিক সংস্থার তথ্যমতে আরও কয়েকটি দেশেও ‘ক্ষুধার মাত্রা খুবই উদ্বেগজনক’ অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, কঙ্গো, ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চল, পাকিস্তান, সোমালিয়া, সিরিয়া এবং ইয়েমেন।

২০২৪ সালের মার্চে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছিল যে অনবরত বাড়তে থাকা গ্যাং সহিংসতার কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন হওয়া হাইতি ‘ধ্বংসাত্মক ক্ষুধা সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে’। সেখানকার প্রায় ১৪ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, তারচেয়ে এক ধাপ নিচের স্তরে আছে আরও ৩০ লাখ মানুষ। আইপিসির মতে, হাইতির খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ‘আশঙ্কাজনক’।

কী কারণে দুর্ভিক্ষ হয়?
আইপিসি বলছে, দুর্ভিক্ষ এবং চরম খাদ্য সংকটের একাধিক কারণ রয়েছে। মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণে কিংবা দুটোর সংমিশ্রণে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার বলছে, ‘বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার মূল কারণ’ সংঘাত।

সুদানের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের জন্য এটি অপর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ও খাবারের উচ্চ মূল্যকে দায়ী করছে। এতে বলা হয়েছে, গাজায় চলমান সংঘাতের কারণে জীবন রক্ষাকারী খাদ্য, জ্বালানি ও পানি ভূখণ্ডটিতে ঢুকতে পারছে না।

উত্তর গাজায় মানবিক সংস্থাগুলোর ‘প্রায় ঢুকতেই না পারা’র বিষয়টিকে তুলে ধরেছে আইপিসি। আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির (আইআরসি) মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে চরম আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণে সৃষ্ট খরা ও ফসল উৎপাদনে ব্যর্থতায় খাদ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকায় এই ঘাটতি ব্যাপক। আরো একটি কারণ এলো নিনো। এটি মূলত জলবায়ুর একটি ধরন, যার কারণে প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের জলের উষ্ণতা অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যায়। সংস্থাটির মতে, ইতিমধ্যেই এল নিনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় খাদ্য সরবরাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করলে কী হয়?

দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হলে কোনো নির্দিষ্ট অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হয় না। তবে এর ফলে খাদ্য সরবরাহ এবং জরুরি তহবিল সরবরাহ করা জাতিসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।

কিছু মানবিক সংস্থা যেমন- আইআরসি অপুষ্টির চিকিৎসা দেয়। গাজার অংশীদারদের সাথে মিলে খাবার ও চিকিৎসার জন্য ভাউচার এবং নগদ অর্থ বিতরণের কাজ করে অক্সফাম৷

সুদানে রাস্তা এবং স্কুলের মতো অবকাঠামো পুনরুদ্ধারে কাজ করছে ডব্লিউএফপি। তাদের মোবাইল রেসপন্স টিমও রয়েছে- যারা খাবার ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছায়। সাধারণত দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার আগেই তা এড়াতে অনেক সংস্থা পরিকল্পনা করে ও সহায়তা দেয়া শুরু করে। বিশেষ করে যখন একটি দেশকে তৃতীয় ধাপ বা তার উপরে শ্রেণিকরণ করা হয় তখনই এই পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়।

এর আগে কোথায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে?

সর্বশেষ ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। তিন বছরের গৃহযুদ্ধের পর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ অনাহারে এবং আরও দশ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ছিল। সে সময় কৃষির ওপর যুদ্ধের প্রভাবকে এর জন্য দায়ী করে জাতিসংঘ। সেসময় কৃষকরা গবাদি পশু হারিয়েছিল, ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছিল এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল।

আগের দুর্ভিক্ষের মধ্যে আরো আছে, ২০১১ সালে দক্ষিণ সোমালিয়া, ২০০৮ সালে দক্ষিণ সুদান, ২০০০ সালে ইথিওপিয়ার সোমালি অঞ্চলের গোডে, ১৯৯৬ সালে উত্তর কোরিয়া, ১৯৯১-৯২ সালে সোমালিয়া এবং ১৯৮৪-৮৫ সালে ইথিওপিয়া। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫২ সালের একটি সময় পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড অনাহার ও রোগে ভুগেছে। অনেকেই সেসময় দেশত্যাগ করে, যা পরবর্তী সময়য়ে ‘মহা দুর্ভিক্ষ’ নামে পরিচিত পায়। সেসময় দেশটির এক তৃতীয়াংশ মানুষ আলু খেয়ে জীবন ধারণ করতো। বলা হয়ে থাকে, কোনো এক রোগের কারণে আলু উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় তখন দশ লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু এর মধ্যেও সেই সময়ে দ্বীপটি শাসন করা গ্রেট ব্রিটেনে আলু আমদানি অব্যাহত ছিল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button